খালি পায়ে হাটতে গিয়ে পায়ে কাটা বিঁধেছে। প্রথমে ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দেইনি। কিন্তু যখন গুরুত্ব দিলাম, তখন আর কিছুই করার থাকলো না। ডাক্তার বললেন-পা কেটে ফেলা ছাড়া কোন উপায় নেই। কী আর করার। একটা পায়ের চাইতে তো জীবনের মূল্য অনেক বেশী। আর কিছুক্ষণ পর আমার পা কেটে ফেলার জন্য অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হবে। আমার চারপাশে সবাই যে যেভাবে পারছে দুঃখ প্রকাশ করছে। সবাইকে দেখতে পেলেও মা-কে দেখতে পেলাম না।
একটু পরেই দেখলাম মা হাতে কিছু একটা নিয়ে দৌড়ে আসছে। মা কাছে আসার পর দেখলাম মায়ের হাতে একটা ঝুরি। সবার দৃষ্টি এখন মায়ের দিকে চলে গিয়েছে। মা কাঁদতে কাঁদতে বললো, এই ঝুরিটাকে আর আমার বাসায় ঢুকাবো না। এই জিনিসটাকে দেখলেই আমার ছেলের পায়ের কথা মনে পরে যাবে। নে বাবা, শেষবারের মতো একটা লাথি মার। আমি বললাম, কিভাবে লাথি মারবো মা? আমি তো আমার পাকে অনুভবই করতে পারছিনা। মা এবার ঝুরির দিকে তাকিয়ে কাঁদতে লাগলো। এইটা হলো আমাদের বাসার ময়লা ফেলার ঝুরি। বাসার গেটের সামনে এইটা রাখা ছিল। আমি মন-মেজাজ খারাপ করে যতদিন বাসা থেকে বের হয়েছি, এই ঝুরি বেচারা ততদিনই আমার লাথি খেয়েছে। তবে খুবই মজবুত। এত লাথি খেয়েও ভাঙ্গেনি। যেদিন পায়ে কাটা বিধলো, সেদিনও এই ঝুরি বেচারা আমার লাথি খেয়েছে। সকাল বেলা দোস্ত কাফি ফোন দিয়ে বললো, “নিশিতা আজকে হাটতে বের হয়েছে। সাথে ওর দাদু। এইরকম সুজোগ আর পাবিনা। তারাতারি আয়।”
একটু পরেই দেখলাম মা হাতে কিছু একটা নিয়ে দৌড়ে আসছে। মা কাছে আসার পর দেখলাম মায়ের হাতে একটা ঝুরি। সবার দৃষ্টি এখন মায়ের দিকে চলে গিয়েছে। মা কাঁদতে কাঁদতে বললো, এই ঝুরিটাকে আর আমার বাসায় ঢুকাবো না। এই জিনিসটাকে দেখলেই আমার ছেলের পায়ের কথা মনে পরে যাবে। নে বাবা, শেষবারের মতো একটা লাথি মার। আমি বললাম, কিভাবে লাথি মারবো মা? আমি তো আমার পাকে অনুভবই করতে পারছিনা। মা এবার ঝুরির দিকে তাকিয়ে কাঁদতে লাগলো। এইটা হলো আমাদের বাসার ময়লা ফেলার ঝুরি। বাসার গেটের সামনে এইটা রাখা ছিল। আমি মন-মেজাজ খারাপ করে যতদিন বাসা থেকে বের হয়েছি, এই ঝুরি বেচারা ততদিনই আমার লাথি খেয়েছে। তবে খুবই মজবুত। এত লাথি খেয়েও ভাঙ্গেনি। যেদিন পায়ে কাটা বিধলো, সেদিনও এই ঝুরি বেচারা আমার লাথি খেয়েছে। সকাল বেলা দোস্ত কাফি ফোন দিয়ে বললো, “নিশিতা আজকে হাটতে বের হয়েছে। সাথে ওর দাদু। এইরকম সুজোগ আর পাবিনা। তারাতারি আয়।”
আমি মার কাছে টাকা চাইলাম। জুতো নাই। মা বললো,
“গত সপ্তাহে না জুতা কেনার জন্য টাকা নিলি? জুতা কী ভাতের মতো খাস নাকি?”
এই কথা শুনে আমার মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। “জুতা খাই মানে? জুতা চুরি গেছে, টাকা দিবা। এত পেঁচিয়ে কথা বলো ক্যান? আর আমি তো বললামই কালকে জুমু’আর নামাজ পড়তে গিয়ে জুতা চুরি গেছে।” আসল কথা হচ্ছে জুতা চুরি-টুরি কিচ্ছু হয়নি। ওইটা কাফিকে দিয়ে দিয়েছি। কোন এক অলুক্ষুনে সময়ে ওর থেকে পাঁচশত টাকা ধার নিয়েছিলাম। অনেকদিন হয়ে গেলেও টাকা না দেয়াতে শালা আমার জুতাই খুলে রেখে দিল। বাসায় এসে মাকে তো কিছু একটা বলতে হবে। বললাম মসজিদের বাইরে জুতা রেখে নামাজ পড়তে গেছি। বের হয়ে দেখি জুতা নাই। আজব! মানুষ কী ধর্ম-কর্ম একেবারেই ভুলে গেল নাকি। মা আমার কথায় কান দেয়নি। তাই আজকে আবারও জিজ্ঞেস করছে জুতা কী করলাম। মায়ের হাত থেকে টাকাটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলাম। তারপর রাগে ফুসতে ফুসতে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। মেইন গেট অতিক্রম করার সময় গেটের পাশে রাখা ময়লা ফেলার ঝুরিটাতে কষে একটা লাথি মারলাম। ঝুরিটা কয়েক হাত দূরে গিয়ে পড়লো। ঝুরির ময়লা পরে চারিদিক সয়লাব হয়ে গেল। আমি বের হয়ে কাফিকে ফোন দিলাম।
“ওই শালা! মা জুতা কেনার টাকা দেয়নাই। ভদ্র ছেলের মতো জুতা জোড়া নিয়ে আয়। রাস্তার মধ্যে খালি পায়ে দাঁড়িয়ে থাকা যায় নাকি?”
কাফি বললো কলিমের চায়ের দোকানে এসে জুতা নিয়ে যেতে। ওখানে যাওয়ার সময়ই পায়ে কাটা বিঁধলো। তেমন গুরুত্ব দেইনি তখন। কলিমের দোকান থেকে জুতা নিলাম। কাফির টাকায় চা খেলাম। তারপর কাফিকে নিয়ে গেলাম সোজা হাউজিং কমপ্লেক্সের ওদিকে। যেখানে নিশিতা ওর দাদুর সাথে হাটছে। নিশিতা আর ওর দাদু সামনে। আমরা দু’জন পেছনে। নিশিতা কিছুক্ষণ পরপর কঠিন মুখ করে পেছনে তাকাচ্ছে। আমি দাত কেলিয়ে হেসে দিচ্ছি। নিশিতার দাদু পুরনো দিনের গল্প শুরু করেছে। “বুঝলিরে বইন! তখন আমি তাগরা যুবক। প্রত্যেকদিন অন্তত একবার তোর দাদীর বাপের বাড়ীর আশেপাশে ঘুরঘুর না করলে পেটের ভাত যেন হজম হয়না। একদিন হল কী, আমি গেছি তোর দাদীর সাথে ইটিশ-পিটিশ করতে। বাড়ীর পেছন দিকে। ডান দিকে রাস্তা। আর বামে কাঁচা পায়খানা। কিছুক্ষণ কথা বলার পরেই তোর দাদীর বাপ হম্বি-তম্বি করতে করতে রাস্তা দিয়ে দৌড়ে আসলেন। আর আমি করলাম কী, কাঁচা পায়খানার...”
নিশিতা চরম বিব্রত বোধ করছে। নিশিতা ওর দাদুকে ধমক দিয়ে বললো, চুপ থাকো তো তুমি।
কিছুক্ষণ পর নিশিতা ওর দাদুকে একটা রিক্সায় উঠিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিল। ও ভার্সিটিতে যাবে। ওর দাদু চলে যাওয়ার পর আমাকে কাছে ডাকলো। আমাকে বললো,
“ভালো হবে কবে? পেছন পেছন ঘুরঘুর করা ছাড়া আর কোন কাজ নাই তোমার? তোমাকে সত্যিই এবার আমি পুলিশে দেব।”
নিশিতা সেদিন আমাকে পুলিশে দেয়নি। বিকেলে জীবনে প্রথম বারের মতো ফোন দিল। ওর ভার্সিটির পাশে পার্কে আসতে বললো। বিকেলে আমার হাত ধরে বললো,
“এখনকার মতই পাগলের মতো ভালোবাসবে তো আমাকে সারাজীবন?”
আমি মাথা নেড়ে হা বলেছিলাম। সেদিন আমি একেবারেই চুপসে গিয়েছিলাম। কোন কথাই মুখ দিয়ে বের হতে চাচ্ছিল না। আমি শুধু হা করে নিশিতার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নিশিতার চোখের রঙ দেখছিলাম।
তারপর থেকে নিশিতার সাথে প্রত্যেকদিন দেখা করতাম। একদিন দেখা না করতে পারলে রাতে ঘুম হতোনা। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতোনা। চাঁদের রাতকেও মনে হতো যেন গুমোট বাঁধা অন্ধকার। অমাবস্যা। নিশিতার সাথে শুধু প্রেমালাপই হতোনা। ঝগড়াও হতো। প্রত্যেক মাসেই প্রায় একবার করে হলেও ছ্যাকা খেতাম। যদিও দুইদিন যেতে না যেতেই আবার সবকিছু ঠিক হয়ে যেত। নিশিতা যখন রেগে যেত তখন ওর রাগ ভাঙ্গানো খুবই কষ্টের হতো। একদিন সকাল বেলা ফোন দিল। বললো ও আজকে ভার্সিটিতে যাবেনা। আমাকে নিয়ে ওর কোন এক বান্ধবীর বাসায় যাবে। আমরা ওর বান্ধবীর বাসা থেকে ফিরে আসার সময় আকাশ কাঁপিয়ে মেঘ ডাকতে শুরু করলো। রিক্সার হুড তুলে দিলাম। কিছুক্ষণ পর আওলা-ঝাওলা বৃষ্টি নামতে শুরু করলো। রিক্সাওয়ালা বসার সিটের নিচ থেকে পলিথিন বের করে আমাদের ঢেকে দিলেন। তারপরেও ও ভিজে যাচ্ছিলো। দু’জনই চাপাচাপি করে বসে থাকলাম। ওর চুলের কিছু অংশ ভিজে গেছে। ফর্সা গালে কিছুটা চুল লেপ্টে আছে। আমি কিভেবে যেন কোন কিছু চিন্তা না করেই আলতো করে হাত দিয়ে ওর গাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিলাম। তারপর দু’হাত দিয়ে ধীরে ধীরে ওর গালটা আমার ঠোটের কাছে নিয়ে আসতে লাগলাম। তখন কিছু না বললেও কিছুক্ষণ পর বললো,
“কী করলে তুমি এইটা? কিস-হাগ যে আমার একদমই পছন্দের না এইটা তুমি জানোনা? স্যরি! আজকের পর থেকে তোমার সাথে আমার আর দেখা হচ্ছেনা। ভালো থেক।”
সত্যিই তারপর থেকে ওর সাথে আমার আর দেখা হয়নি। ও ফোন বন্ধ করে রেখেছিল। তাঁর পরদিনই আমার পায়ে যন্ত্রনা শুরু হলো। ধীরে ধীরে যন্ত্রনা বারতে লাগলো। ফার্মেসী থেকে সাধারণ কিছু ব্যাথার ট্যাবলেট খেলেও কোন কাজ হলোনা। তাঁর কিছুদিন পরে যখন আর হাটতে পারছিলাম না, তখন মাকে বললাম। মা সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে আসলেন। ডাক্তার নাকি বলেছে পা কেটে ফেলা ছাড়া উপায় নেই। আজকে আমার পা কেটে ফেলা হবে। আমাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানোর আগে শেষবারের মত পা-টাকে দেখে নিলাম। কিন্তু আমি খুব অবাক হচ্ছি। সবাই কেমন যেন নাটকীয় দুঃখ দুঃখ ভাব মুখে এনে দাঁড়িয়ে আছে। খালি মা-কাঁদছে। অবশেষে আমাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানো হলো। আমার পা কেটে ফেলা হবে অথচ খালি পা-টাকেই অবশ করা হলো। নিজেকে মানুষিক ভাবে প্রস্তত করে নিলাম। ডাক্তারেরা আমার পা কাটা শুরু করলেন। সুন্দরী এক ডাক্তার চশমার ফাক দিয়ে কিছুক্ষণ পরপর আমার দিকে তাকাচ্ছেন। একবার ভেবেছিলাম ভেংচি কেটে দেই। পরে আবার ভাবলাম, ভালো পা-টাকেও ওরা আবার শত্রুতার রেশ ধরে নষ্ট করে দিতে পারে। প্রায় দু’ঘন্টা আমার পা কাটাকুটি চললো। তারপর আমাকে ঘুমের ওসুধ খাইয়ে ঘুম পারানো হলো। ঘুম থেকে উঠলাম প্রায় চার ঘন্টা পর। উঠেই সবার আগে তাকালাম আমার পায়ের দিকে। এ কী! ওরা কী পা-টা কেটে নতুন করে আরেকটা পা লাগিয়ে দিয়েছে নাকি! কী আশ্চর্য্য! আমার পা তো আগের মতই আছে। মা-কে বললাম, মা আমার পায়ে একটা খামচি দাওতো। মা বললো, হয়েছে হয়েছে। পাকনামী বাদ দিয়ে দুধটুকু খেয়ে নে। পাশে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সবার মাঝে নিশিতাও আছে। নিশিতা এখানে কিভাবে আসলো সেইটা আমি জানিনা। জানার চেষ্টাও করিনি। নিশিতাকে খুব সুন্দর লাগছে। মেয়েটা এখনও মুখ গোমড়া করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মনে মনে বললাম,
“রাগলে এতটা সুন্দর লাগে তোমায় আগে জানতাম না। জানলে বারবার চুমু দিয়ে তোমাকে রাগিয়ে দিতাম। আর তোমার রাগান্বিত সৌন্দর্য দেখতাম।”
তাঁর দু’দিন বাদে আমি শুনেছিলাম, আমার পা কাটার কোন বন্দবস্ত ডাক্তারদের সাথে হয়নি। পায়ে কাটা বিঁধার পরেও অনেকদিন কোন ব্যবস্থা না নেয়াতে জায়গাটাতে পুশিং হয়েছিলো। ছোট একটা অপারেশনের মাধ্যমে ক্লিন করা হয়েছে। আমাকে ভয় দেখানোর জন্য পা কাটার কথা বলা হয়েছিল। আমার পা ঠিক হতে প্রায় একমাস লেগে গেল। এই একমাসে নিশিতাকে একবারও দেখা হয়নি। তবে ফোনে কথা হয়েছে। ঝগড়া হয়েছে। একমাস পর একদিন সন্ধায় নিশিতাকে খুব মনে পরলো। ওকে না দেখতে না দেখতে প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। বাসা থেকে বের হলাম। বের হওয়ার সময় দেখলাম গেটের সামনের ঝুরিটা পরে আছে। আমি সোজা করে বসিয়ে রেখে বললাম, আর তোকে লাথি দেবনা। একটা রিক্সা নিয়ে সোজা নিশিতার বাসার দিকে চলে গেলাম। আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো বৃষ্টি নামবে। ওদের দো’তলা বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে ফোন দিলাম। নিশিতা মোবাইল কানে নিয়ে দো’তলার বারান্দায় আসলো। ও খুব রাগ করছিলো রাত করে ওদের বাসার ওদিকে যাওয়াতে। আমি ওর রাগ আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
-নিচে আসো। তোমাকে কাছ থেকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
-ইশ! ঢং আর কী। বাবা বাসায়। নিচে নামলে আমাকে আস্ত গিলে খাবে।
-নিচে নামলে নামো। তুমি নিচে না নামলে আমি আজ সারারাত এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো। বৃষ্টি তো দূরে থাক, কালবৈশাখীর ঝর এলেও যাবোনা।
-দাঁড়িয়ে থাকলে থাকো। আমি নিচে আসতে পারবো না।
নিশিতা ফোন রেখে ভিতরে চলে গেল। আমি নিস্পলক ওদের ব্যালকুনির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আকাশে মেঘ দেখেও এত কষ্ট করে আসলাম। আর সে নিচেই আসতে পারবে না। ধুর!
বৃষ্টি নামা শুরু করলো। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম আগের জায়গাতেই। ও হয়তো আবারও বৃষ্টির পানি ছুঁতে ব্যালকুনিতে আসবে। কাছ থেকে না হোক, দূর থেকেই আরেকবার দেখে চলে যাবো। দূর থেকে আর দেখতে হলোনা। ছাতা মাথায় নিশিতা স্ব-শরীরে হাজির হলো। নিশিতা সেদিন সেই বৃষ্টিতে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলো। হুহু করে কাঁদছিলো। নিশিতা আমার বুকে গাল রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো,
“এত ভালোবাসো ক্যানো আমায়?”